কোন ভোটারই
যেন নির্বাচক তালিকা থেকে বাদ না যায়
অমরনাথ
কর্মকার ১৯/০১/২০২২
ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র। গণতন্ত্রে, নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণ গণতন্ত্রের অস্তিত্ব রক্ষায় এটি অপরিহার্য। নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণ সরকার গঠনে অংশগ্রহণ করে। আঠারো বছরের বেশি বয়সী প্রতিটি নাগরিকের ভোট দেওয়ার অধিকার রয়েছে। জাতি, সম্প্রদায়,লিঙ্গ বা ধর্মের ভিত্তিতে তাদের বৈষম্য করা যায় না। ভোটাররা "তাদের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করার জন্য স্বাধীন"।
গণতন্ত্র
হল জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা গঠিত জনগণের
সরকার। সুতরাং ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সরকার বা জনপ্রতিনিধি
নির্বাচনে প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের সক্রিয় অংশ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরী। এই
দৃষ্টিভঙ্গি মাথায় রেখেই ভারতের নির্বাচন কমিশন সমাজের প্রতিটি স্তরের নাগরিককে
নির্বাচক তালিকায় নাম নথিভুক্তিকরণের প্রয়োজনীয় সব রকম সুবিধা প্রদান করতে বদ্ধ
পরিকর, বিশেষতঃ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষজন,যৌনকর্মী, প্রতিবন্ধী
এবং প্রবীণ নাগরিকদের জন্য বিশেষ সুবিধা দানে এগিয়ে এসেছে। সেইজন্য নির্বাচন কমিশন
‘সকল ভোটার নির্বাচক তালিকায় নথিভুক্ত থাকবেন’ এই নীতিবাক্যের সফল ও সম্পূর্ণ
বাস্তবায়নে নিরন্তর কাজ ক’রে চলেছে। তারই অঙ্গ হিসাবে দেশজুড়ে প্রায় সারা বছরই চলে
সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি। নির্বাচনের সময় বিশেষভাবে সক্ষম এবং প্রবীণ
নির্বাচকদের জন্য ভোট কেন্দ্রে থাকে নানান সুবিধা, যেমন হুইল চেয়ার, নির্বাচন
কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য বিশেষ পরিবহনের সুব্যবস্থা, র্যাম্প, স্বেচ্ছাসেবক, ব্রেইল ব্যালট পেপার কিংবা স্বহস্তে ভোটদানে অক্ষম
নির্বাচকের জন্য সঙ্গীর ব্যবস্থা।
ভোট
দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ কারণ প্রতিটি পূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তি দেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণের
প্রক্রিয়ার অংশ গ্রহণের অধিকার প্রয়োগ করে। আমাদের সমাজের স্বাভাবিক প্রবণতা হ’ল
শারীরিক বা মানসিকভাবে বাধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে দূরে
রাখা। কিন্ত ভারতের মত একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম গণতান্ত্রিক দেশে তাঁদেরও অধিকার
আছে দেশ পরিচালনায় তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রদানের এবং সরকারের কাছে তাঁদেরও চাহিদা জানানোর সমান অধিকার আছে। তাই
নির্বাচনে তাঁদেরও একশ শতাংশ অংশগ্রহণ জরুরী।
‘দ্য স্পিরিট অব লজ’ বইয়ে
মন্টেসকিউই বলেছেন যে, দেশের প্রশাসন অথবা প্রশাসনের অধীনে থাকা জনগণ সর্বক্ষেত্রেই গণতন্ত্র বিদ্যমান এবং এই দুটি অবস্থার
মধ্যেই পর্যায়ক্রমে ভোটারদের থাকতে হয়। নিজেদের দেশে কোন সরকার আসবে তা বাছাই করার
মালিক অথবা মাস্টার হিসেবে কাজ করে ভোটাররাই, ভোট দিয়ে একটি সার্বভৌম (অথবা শাসন) ব্যবস্থাকে চালু রাখে জনসাধারণই। সভ্যতার ইতিহাসের প্রাচীন কাল থেকেই প্রাচীন গ্রীস ও প্রাচীন রোমে
নির্বাচনের ব্যবহার হয়ে আসছে এবং গোটা মধ্যযুগে পবিত্র রোমান সম্রাট ও পোপের মত
শাসক বাছাই করতেও নির্বাচনের ব্যবহার হতো। প্রাচীন ভারতে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রজারা বাছাই করতেন রাজাদের। প্রাচীন ভারতের খালিফ, মধ্যযুগের গোড়ার দিকে রশিদুন খলিফৎ এবং বাংলার মধ্যযুগের গোড়ার দিকে পাল রাজাদের মধ্যে গোপালকে বাছাই করতে এই নির্বাচন করা
হয়েছিল। তবে আধুনিক ‘নির্বাচন’ হলো জনগণের ভোটে সরকার নির্বাচন।
২০১১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর-এ
নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত এক
সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে যে, বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে ভোটের প্রতি ক্ষোভ ও বিরূপতা ক্রমবর্ধমান৷
তাই, ভোটের হারের এই ক্রমাবনতি ঠেকাতে
বহু গণতান্ত্রিক দেশ যেমন অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ,
সাইপ্রাস, গ্রিস- বাধ্যতামূলক ভোটদানের নিয়ম বলবত্ করেছে৷ বস্তুত, অস্ট্রেলিয়াতে এই নিয়ম চালু
আছে ১৯২৪ সাল থেকেই৷ কিন্তু এই বাধ্যতামূলক ভোটদান
গণতান্ত্রিক ধারণা ও কাঠামোর সঙ্গে
অসঙ্গতিপূর্ণ, অসামঞ্জস্যপূর্ণ৷ ভারতে প্রায়ই দেখা যায় বিক্ষুব্ধ নাগরিকদের ভোট বয়কট করতে। ভোটদান বিধিবদ্ধ অধিকার হলেও, সরাসরি মৌলিক অধিকারভুক্ত না হলেও, গণতন্ত্রের
সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্ত, নিজ প্রতিনিধি বাছাই না বাছাই-এর
প্রশ্নটির সঙ্গে নিবিড় ভাবে যুক্ত৷ এবং সেখানে গোপনীয়তা যেমন আবশ্যক, প্রার্থী পছন্দ না হলে গোপনীয়তার
সঙ্গে তা জানানোর অধিকারও
তেমনই আবশ্যিক ভাবে ভোটারদের থাকা উচিত৷ তাই ২০১৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ভোটপ্রার্থীদের
প্রতি নাগরিক তথা ভোটারদের ‘না-পছন্দের অধিকার’-কে সাংবিধানিক স্বীকৃতি
দিয়ে ব্যালটে বা ইভিএম-এ
উল্লিখিত প্রার্থীদের কাউকেই পছন্দ নয় (None of the above =
NOTA)-র অধিকারকে মেনে নেওয়া হয়েছে৷ গণতন্ত্রকে আরও জীবন্ত, প্রাণবন্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। তাই এখন কোন নির্বাচক ইচ্ছে করলে এই ‘নোটা’ বোতাম টিপে তাঁর অপছন্দ প্রকাশ করতে পারেন। ফলে প্রার্থীদের প্রতি আস্থাহীন কোন নির্বাচকও ভোটদানের মাধ্যমে তাঁর
আস্থাহীনতা অনায়াসে প্রকাশ করতে পারবেন – তার জন্য তাঁকে ভোটদান থেকে বিরত থাকার প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ একজন নির্বাচক ভোটদানের মাধ্যমে তাঁর প্রকৃত মতামত প্রয়োগ করতে পারেন।
ভারতের নির্বাচন কমিশন সকল প্রাপ্তবয়স্ককে নির্বাচক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন ক’রে থাকে।
ভোট দানের মাধ্যমে মানুষ যাতে তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন তাঁর জন্য নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সর্বস্তরের নির্বাচকদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা করেছে। নির্বাচক তালিকায় নাম তোলার পদ্ধতি সহজতর করেছে, এমনকি নির্বাচক তালিকায় নাম তোলার জন্য আবেদনকারীকে শারীরিকভাবে উপস্থিত না থেকে অনলাইনে
আবেদন করার পদ্ধতিও চালু করেছে। ভারতের গণতন্ত্রকে আরোও শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যেই নির্বাচন কমিশনের এই নিরলস প্রয়াস।
গণতন্ত্রে যত বেশি সংখ্যক
নির্বাচক নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবেন, সরকার বা প্রশাসন তত
বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে যা দেশের সার্বিক
উন্নয়নের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয়। গণতন্ত্রে দেশের জনগণকে সার্বভৌম মনে করা হয়। মূলত দেশের শাসন ক্ষমতার মূল উৎস হ’ল জনগণ
– এটাই গণতন্ত্রের মৌলিক বিশ্বাস। সেই কারনেই শাসন ক্ষমতা লাভের জন্য রাজনৈতিক নেতাদের জনগণের কাছে গিয়ে ভোট প্রার্থনা করতে হয়। এদের মধ্যে থেকেই আস্থাশীল প্রার্থী নির্বাচিত হন জনগণের দেওয়া
ভোটে। এই ভোটদানের মাধ্যমেই
নির্বাচক মন্ডলী জনগণের সার্বভৌমত্বের মহিমা প্রতিষ্ঠা করে। এছাড়া জনগণের দেওয়া ভোটে গঠিত সরকারকে প্রভাবিত করা, সরকারী কর্মসূচিতে প্রভাব সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে নির্বাচকদের উল্লেখযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে।
সুতরাং আমাদের মত বিপুল জনসংখ্যার
বিশাল এই গণতান্ত্রিক দেশের
সার্বিক উন্নয়নের প্রয়োজনে উপযুক্ত এবং আদর্শ সরকার গড়ার লক্ষ্যে ভারতের প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক নরনারীকে নির্বাচক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রয়োজন এবং প্রতিটি নির্বাচককে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করা উচিৎ যাতে জনগণের রায়ে গঠিত সরকার দেশ ও দশের সার্বিক
উন্নয়নে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
নির্বাচকমন্ডলীই মূলত একটি রাষ্ট্রের যাবতীয় ক্ষমতার নির্ধারক। কোন দল ক্ষমতায় যাবে,
রাষ্ট্র পরিচালনা করবে, আইন প্রনয়ণ করবে তা নির্ধারণে নির্বাচকমন্ডলীর
রায়ই চূড়ান্ত। তাই দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রের সার্বর্ভৌমত্ব যেমন নির্বাচকমন্ডলীর রায়ের মাধ্যমে প্রতিযলিত হয়, তেমনি সরকার গঠন হওয়া থেকে শুরু ক’রে সরকারী
কার্যক্রম পরিচালনার তদারকি, আইন প্রনয়ণ, সংবিধান সংশোধন এবং রাজনৈতিক দলের সমগ্র কার্যক্রম প্রভাবিতকরণে নির্বাচক মন্ডলী সক্রিয় ও ব্যাপক উল্লেখযোগ্য
ভূমিকা পালন করে। তাই বলা যায় যে, প্রতিনিধিত্বশীল ও প্রত্যক্ষ গনতান্ত্রিক
ব্যবস্থায় নির্বাচকমন্ডলী সরকারের চতুর্থ অঙ্গস্বরূপ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন