মঙ্গলবার, ১১ আগস্ট, ২০১৫

বাস্তবের সাথে দ্বন্দ্ব



আমাদের পাড়ায় বহু পুরাতন একটা রাজবাড়ী ছিল । শুনতাম ওটা ছিল প্রাচীন এক রাজার নাচ ঘর । বাড়িটার সামনে ছিল একটা সুন্দর বাঁধানো পুকুর । ছোটবেলায় ঐ পুকুরে দেখতাম অনেকগুলো রাজহাঁস খেলা করতে । আমাদের কাছে সেই রাজহাঁসগুলো ছিল প্রতিদিনের দর্শনীয় বিষয় । রাজহাঁস গুলোর সুন্দর বিপুলাকায় চেহারা আমাদের বিস্ময়ের উদ্রেক করত কারন আর কোথাও ওরকম হাঁস দেখতে পেতাম না । শুধুমাত্র রাজবাড়ীতেই ঐরকম হাঁস দেখতে পেতাম বলে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে রাজার হাঁস বলেই হয়ত এদের এমন সুন্দর চেহারা, এমন বিপুল আকৃতি । কিন্তু এতদিনের বদ্ধমুল ধারণার সঙ্গে স্কুলের বাংলা ব্যাকরন সারের শেখানো রাজহাঁসের ব্যাসবাক্য আমাকে প্রচণ্ড দ্বন্দ্বে ফেলে দিল । স্যার বললেন রাজহাঁস হ’ল হাঁসের রাজা । খুব ছোট বেলা থেকে জন্মানো বিশ্বাসের সঙ্গে বেমানান একটা সম্পূর্ণ বিপরীত জিনিসকে মেনে নিতে কিছুতেই মন চাইছিল না । কিন্তু স্যারের প্রতি বিশ্বাস না রাখা মানে তাঁকে অসম্মান করার সামিল । অতএব, খাতায় কলমে ‘হাঁসের রাজা’ আমার মনে আজও ‘রাজার হাঁস’ হয়েই আছে ।
এ রকম আরও বাস্তবলব্ধ বিশ্বাস আর ছাপার অক্ষরে লেখা তথ্যের ফারাক একটা মানসিক বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে সেই ছোট্ট বেলা থেকে । আমাদের গ্রামে ছোট বেলায় শহরের পিচঢালা রাস্তা বলতে যা বোঝায়, সে রকম কোন পাকা রাস্তা ছিলনা । তার পর একদিন শুনলাম আমাদের গ্রামে রাজপথ তৈরি হবে । মাস দুয়েকের মধ্যে হয়েও গেল । আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে বিকেল হলে একরাশ কৌতূহল নিয়ে দেখে আসতাম রাজপথ তৈরির ক্রিয়া কৌশল আর মনে মনে দিন গুনতাম কবে রাজপথ তৈরি শেষ হবে । তারপর একদিন রাজপথ চালু হল । গ্রামের সবার মধ্যে ইতিমধ্যে রাজপথ তৈরির সুবাদে জন্মে গিয়েছে কেমন যেন হাল্কা শহুরে মানসিকতা । ব্যতিক্রম শুধু আমাদের পাড়ার বিনুদা’র । বিনুদার গোরুর গাড়ী চালিয়ে সংসার চলে । জানা গেল রাজপথ দিয়ে গোরুর গাড়ী, ঠেলা গাড়ী এসব চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে । শহর থেকে মোটর গাড়ী আসছে রাজপথ দিয়ে । মোটর গাড়ীর শব্দে আমাদের গ্রামে শহুরে মেজাজ । কেবলমাত্র বিনুদা’কেই দেখতাম রাজপথ হওয়ার পর থেকে সব সময় মন খারাপ করে থাকতে । একদিন সোৎসাহে জিজ্ঞেসই করে ফেললাম “কিগো বিনুদা, রাজপথে তোমার গোরুর গাড়ী চলতে দিচ্ছে না ব’লেই কি তোমার মন খারাপ ? অন্য রাস্তায় তো তোমার গাড়ী চলছেই ।“  বিনুদা অভিমানে জবাব দিয়েছিল “রাজার রাস্তায় কি গোরুর গাড়ী মানায় ?” চট করে সদ্য শেখা ‘রাজপথ’-এর ব্যাসবাক্য মনে পড়ে গেল ।  শিখেছি ‘রাজপথ’ মানে পথের রাজা । কিন্তু বিনুদার কথাটা শুনে মনে হ’ল সত্যিই তো রাজপথ নিশ্চয়ই রাজার পথ – তাই ঐ পথে কিছু কিছু যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা, পথের রাজা হলে নিশ্চিত সব ধরণের যান নির্দ্বিধায় চলাচলের ছাড়পত্র পেত – বিনুদার মত কাউকে এভাবে দুঃখ পেতে হ’ত না । আবার দ্বন্দ্ব তৈরি হ’ল মনে ।
দ্বন্দ্বটা আরও ঘনীভূত হতে থাকল যখন ‘রাজবাড়ী’ আর ‘রাজপথ’ মাথার মধ্যে রীতিমত কুস্তি করতে থাকে । রাজপথ যদি পথের রাজা হয়, তাহলে বিশাল বিশাল অট্টালিকা মাত্রেই কেন রাজবাড়ী নয় ? অথচ রাজবাড়ী বলতে এককথায় আমরা রাজার বাড়ীকেই বুঝে নিই । এই দ্বন্দ্ব নিয়েই আমি এবং আমার মত অনেকেই, বোধহয় সকলকেই চলতে হয় । কোনটা ঠিক সেটা যদি আমাদের বাস্তবের উপলব্ধি থেকে ঠিক করে নেওয়া যেত, তাহলে এই টানাপড়েনে ভুগতে হত না আমাদের । ‘নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল’ না ‘দুষ্ট গোরু র চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল’ কোনটা আদতে ঠিক তা বাস্তব নির্দিষ্ট করে দেয় । আগে দ্ব্যর্থবোধ দূর করা প্রয়োজন ।  কবিতায় বহুমুখী ভাবনা চিন্তার অবকাশ থাকে । বাস্তব কবিতা নয় । যে বাস্তবের পটভূমি আমাদের জীবনের বিচরণক্ষেত্র সেখানে নৈমিত্তিক অভিজ্ঞতালব্ধ সত্যকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিৎ । ‘রাজনীতি’ ‘নীতির রাজা’ নাকি ‘রাজার নীতি’ সে নিয়ে বই-এর পাতায় যাই লেখা থাক না কেন, বাস্তবের অভিজ্ঞতা বলছে রাজনীতি আসলে ‘রাজার নীতি’ই, ‘নীতির রাজা’ কখনোই নয় ।   
অ.না.ক.  ১২/০৮/২০১৫

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মুখ চাপা সত্য

 মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু  নাকি সত্যের চির সমাধি?  নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?