গ্রামীন সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙাল হরিনাথ মজুমদার
অমরনাথ কর্মকার
বাংলায় গ্রামীন সাংবাদিকতার পথিকৃৎ হিসাবে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের নাম আজ বিস্মৃতপ্রায়। সারাজীবন অবহেলিত গ্রাম বাংলার শিক্ষা বিস্তারের জন্য এবং ইংরেজ ও পুঁজিপতিদের শোষনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসাবে তিনিই সম্ভবত প্রথম গ্রাম বাংলায় সংবাদপত্রকে বেছে নেন। জন্মেছিলেন অবিভক্ত বাংলার নদীয়া জেলার কুমারখালি গ্রামের কুন্ডুপাড়ায় ১৮৩৩ সালের ২২ জুলাই। বাবা হরচন্দ্র মজুমদার, মায়ের নাম কমলীনি দেবী। উনিশ শতকে বাংলার হলুদ সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে সত্য এবং তথ্য-ঋদ্ধ সাহসী গ্রামীণ সাংবাদিকতার আদি ও প্রবাদ পুরুষটি বর্তমান প্রজন্মের কাছে প্রায় অচেনা। তার ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ ছিল সে সময় ভারতের তমসাচ্ছন্ন গ্রামজীবনের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। একটা ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। পাবনার ইংরেজ ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট একবার এক দরিদ্র বিধবার একটি দুধেল গরু জোরপূর্বক কেড়ে নেয়। হরিনাথ সেই অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করে ‘গরু চোর ম্যাজিস্ট্রেট’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করেন। এই সংবাদ ছাপা হওয়ার পর ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকা সম্বন্ধে তৎকালীন পাবনা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট মি. হামফ্রে তার চিঠিতে কাঙাল হরিনাথকে লিখেছিলেন, ‘মি. অ্যাডিটর আমি তোমাকে ভয় করি না বটে, তবে তোমার লেখনী পড়ে অনেক কুকর্ম ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি।’
গ্রামের অশিক্ষিত মানুষদের, বিশেষ ক’রে মহিলাদের শিক্ষিত করার প্রয়োজন বোধ ক’রেন তিনি । তাই বন্ধুদের সাহায্যে ১৮৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে নিজ গ্রামে একটি ভার্নাকুলার বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর বেশ কিছুদিন ওই বিদ্যালয়েই বিনা বেতনে শিক্ষকতার মহান পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। পরবর্তীকালে ১৮৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসে কৃষ্ণনাথ মজুমদারকে কুমারখালিতে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করতে তিনি সহায়তা করেন। স্বয়ং ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর সে সময় স্কুলটির উদ্বোধনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। সেই বিদ্যালয়টি আজ ‘কুমারখালি পাইলট বালিকা বিদ্যালয়’ নামে বাংলায় নারীশিক্ষার স্মারক হয়ে সগর্বে অবস্থান করছে কুমারখালিতে। অত্যন্ত গরিব পরিবারে জন্ম হওয়ার কারনে অর্থোপার্জনের জন্য তিনি কিছুদিন নীলকর সাহেবের কাছে কাজ করেছিলেন। সে সময় কুমারখালিতে নীল চাষ হ’ত। কিন্তু নীল চাষিদের ওপর নীলকর সাহেবদের অকথ্য অত্যাচার দেখে সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে গ্রামীণ সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৮৬৩ সালে প্রথম ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ নামে একটি পত্রিকা চালু করেন। পরবর্তীকালে তা পাক্ষিক এবং পরে সাপ্তাহিক পত্রিকায় রুপ নেয়। মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত সেটাই করে গেছেন। এক পয়সা মূল্যের এই পত্রিকাটিতে কাঙাল হরিনাথ অবিরাম নীলকর ও জমিদারদের নানা জুলুমের কথা প্রকাশ করতে থাকেন। পত্রিকাটি প্রকাশের সুবিধার্থে তিনি ১৮৭৩ সালে একটি ছাপাখানা স্থাপন করেন, নাম দেন এম,এন, প্রেস (বন্ধু মথুরানাথের নামে)। এই ছাপাখানা থেকেই নিয়মিত ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ ছাপা হ’ত। কাঙাল হরিনাথের পত্রিকাটি সেই সময়ে নির্যাতিত কৃষক ও প্রজাদের পক্ষের একটি পত্রিকা হিসেবে পরিচিতি পায়। কিন্তু সরকারের কঠোর মুদ্রণনীতি ও নানা বিরোধিতায় ১৮ বছর প্রকাশের পর ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সেই ঊনিশ শতকে গ্রামের নির্যাতিত মানুষের পক্ষে এমন একটি পত্রিকা প্রকাশের কারণে কাঙাল হরিনাথ অমর হয়ে আছেন। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার কুমারখালি শহরে ‘কাঙাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর’ স্থাপন ক’রে কাঙাল হরিনাথের কীর্তি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। কাঙালের সেই ছাপাখানা সেখানে আজও সযত্নে সংরক্ষিত। ইতিহাস অনুরাগী বহু মানুষের নিত্য আগমণ ঘটে সেখানে।
কাঙাল হরিনাথ ছিলেন নিঃস্বার্থ, প্রতিবাদী ও প্রবল সাহসী। হাজার বাধা উপেক্ষা করেও তিনি ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকার মাধ্যমে ইংরেজ শাসন, নীলকরদের নির্যাতন, জোতদার, মহাজন ও পুলিশের অত্যাচার-নির্যাতনের কথা নিয়মিতভাবে প্রকাশ করতেন। সত্য-সংবাদ প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি প্রায়ই শাসকগোষ্ঠী ও জমিদারদের রোষানলে পড়েন। কিন্তু অত্যাচার-নির্যাতনের কথা বলতে ও লিখতে প্রতিবাদে পিছপা হননি। লালন ফকির বেশ কয়েকবার কাঙাল হরিনাথকে সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছিলেন ব’লে জানা যায়। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন লালন ফকিরের আখরা আর কাঙাল হরিনাথের বাসস্থানের দূরত্ব খুব বেশি ছিল না। কাঙাল হরিনাথ লালনের চেয়ে বয়সে ছিলেন ছোট। তবে তাঁদের মধ্যে হৃদ্যতা ছিল অসম্ভব। লালনের গান প্রচারে ছিল তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। একবার হরিনাথ লালনকে তাঁর কিছু গান দেখিয়ে বললেন, ‘ভাই, আমার এ কথাগুলো তোমার কেমন লাগল?’ লালন হেসে উত্তর দিলেন, ‘তোমার এ ব্যঞ্জন বেশ হয়েছে, তবে নুনে কিছু কম আছে।’ এ ছাড়া প্রায় সমসাময়িক এবং স্বল্প দূরত্বে অবস্থান করা ‘বিষাদ সিন্ধু’র স্রষ্টা মীর মশাররফ হোসেন, অক্ষয় কুমার মৈত্রে, জলধর সেনের সঙ্গেও কাঙাল হরিনাথের সুসম্পর্ক ছিল।
তিনি সাংবাদিক-জীবন শুরু করেছিলেন ঈশ্বরগুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায়। তাঁর ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ প্রকাশের মূল লক্ষ্য কৃষকদের ওপর নীলকর সাহেব ও জমিদারদের অত্যাচারের কাহিনী প্রকাশ হলেও এই পত্রিকায় দর্শন, সাহিত্য ও আরোও অনেক বিষয় প্রকাশিত হ’ত। এই পত্রিকায় লালন ফকিরের গানও প্রকাশিত হয়েছে। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি প্রায় ১৮টি বই লিখেছিলেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘বিজয় বসন্ত’, ‘কবিতা কৌমুদী’। কাঙাল হরিনাথ ছিলেন লালন ফকিরের অনুগামী। তিনি ‘কাঙাল ফকির চাঁদের দল’ নামে একটি বাউল দল তৈরি করেন।‘কাঙাল ফকিরচাঁদ ফকিরের জীবনী’ নামে একটি বাউল গানের সংকলনও তিনি প্রকাশ করেন।হরিনাথের একটি বহুশ্রুত গান হল- ‘হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল, পার করো আমারে…’যেটি সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেছিলেন। গানটির রচয়িতার নাম সেই চলচ্চিত্রে উল্লেখ না থাকায় সত্যজিৎ রায় কাঙাল হরিনাথের পরিবারকে দুঃখ প্রকাশ ক’রে চিঠিও লিখেছিলেন। প্রখ্যাত লেখক মীর মশারফ হোসেন,জলধর সেন তাঁদের লেখক জীবনের সূত্রপাত করেছিলেন গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকায়। মীর মশারফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ কাঙাল হরিনাথের প্রেসেই প্রথম ছাপা হয় ব’লে জানা যায়। এছাড়া শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব,অক্ষয় কুমার মৈত্র, প্রসন্নকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
লালনকে দেখে, তাঁর গান শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেই বাউল গানের দল গড়েছিলেন কাঙাল হরিনাথ। নাম দিয়েছিলেন ‘ফিকিরচাঁদ ফকিরের দল’ । সেটি ১৮৮০ সালের কথা। সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন অক্ষয় কুমার মৈত্র, জলধর সেন, পন্ডিত প্রসন্ন কুমার প্রমূখ। তাঁর দলের গান তখন গ্রামের মানুষদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। হরিনাথের মধ্যে ছিল আধ্যাত্মিক চিন্তাধারা। তাঁর বাউল গানে তিনি নিজেকে ‘কাঙাল’ ব’লে উপস্থাপন করতেন ব’লেই তাঁর নামের আগে কাঙাল শব্দের সংযোগ ঘটে।
কাঙাল হরিনাথের জন্মস্থান কুমারখালি থেকে শিলাইদহের দূরত্ব বেশি নয়। হরিনাথ মজুমদার ওরফে ফিকির চাঁদ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগ্রজ, সমকালিন। শোনা যায় হরিনাথ মজুমদারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না। কথিত আছে, সম্পর্ক এতটাই অবনতি হয়েছিল যে কবিগুরু হরিনাথ মজুমদারকে তাঁর কুঠিবাড়িতে ধরে আনার জন্য লাঠিয়াল বাহিনী পাঠিয়েছিলেন। কুমারখালি অঞ্চলে বহু ইতিহাস বিখ্যাত বিশিষ্ট মানুষের জন্ম হয়েছিল। কলকাতা হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি ড. রাধা বিনোদ পাল, ১৮৬০ সালের নীলবিদ্রোহের নেত্রী প্যারী সুন্দরী, বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ
মুখোপাধ্যায়
(বাঘা
যতীন),
কাপড়ের
কল
‘মোহিনী
মিলস্’
এর
প্রতিষ্ঠাতা মোহিনী মোহন চক্রবর্তী, গায়ক গগন হরকরা, ইতিহাসবিদ,আইনজীবি ও সাহিত্যিক অক্ষয় কুমার মৈত্র, আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম সম্পাদক প্রফুল্ল কুমার সরকার এবং আরোও অনেক বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রখ্যাত মানুষজন।
"গ্রামবার্তা প্রকাশিকা" সংবাদপত্রটি ঊনিশ শতকে তৎকালীন সময়ের গ্রাম বাংলার দর্পণ হিসেবে কাজ করতো। এই বিষয়ে হরিনাথ মজুমদারের ভূমিকা অপরিসীম। কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের মৃত্যু হয় ১৬ এপ্রিল, ১৮৯৬। আজ সংবাদপত্র আর পত্র-পত্রিকার প্রাচুর্যের ভিড়ে কাঙাল হরিনাথের কথা বিস্মৃত হ’লে বাংলার গ্রামীন সাংবাদিকতায় তাঁর অবদানকে অবমাননা করা হয়। কারন গ্রামের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, তাঁদের ওপর শাসক ও জমিদারদের নীপিড়নের প্রতিবাদে নির্ভীক সাংবাদিকতা করতে গিয়ে তিনি যে সাহস দেখিয়েছিলেন তা আজকের দিনেও অনুসরণযোগ্য।
অমরনাথ কর্মকার ১২/০৭/২০২২