অকৃতদারঃ অ.না.ক. ১৪/০৪/২০১৫
স্কুল
ছাড়ার পর অনেকগুলো বছর, বরং বৃহত্তর এককে বললে, বেশ কয়েক দশক কেটে গেছে । স্কুলের
বন্ধুদের মধ্যে আজ কেউ ডাক্তার, কেউ মাস্টার, কেউ উকিল, কেউ করণিক,
আবার কেউ বা বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতে গিয়ে নিদ্রাভঙ্গ হয়ে অন্ধকার ছাপাখানার কর্মচারী
। এই দীর্ঘ সময়ে অনেকের সাথে আজও বন্ধুত্ব অটুট, আবার কারো কারো সঙ্গে কালে-ভদ্রে
দেখা হয়। অনেক সময় স্মৃতির অ্যালবাম ঘেঁটে অনেককে চিনে নিয়ে বন্ধুত্ব পুনঃস্থাপন
করেছি । আবার অনেকেই আছে যাদের সেই সময়ের মুখগুলো স্মৃতিতে স্পষ্ট, স্কুল ছাড়ার পর
আজও পর্যন্ত তাদের সঙ্গে দেখা হয়নি । ফেস বুকে তাদের নাম অনুসন্ধান করে অনেককে
পেয়েও গেছি, সামান্য কয়েকজন আছে যাদের সন্ধান আজও পাইনি । আগে কোন বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে দেখা হলে তাদের
বাড়ি যেতাম, কিংবা সে বা তারা আমাদের বাড়ি আসত, হৈ-হুল্লোড় হত । বাইরেও বেড়াতে চলে
যেতাম । এখন সে সুযোগ কম । এখন আর তেমন বান্ধু-বান্ধবের
বাড়ি যাওয়া হয় না । কারন প্রথমত, কাজের চাপে অবকাশের অভাব আর দ্বিতীয়ত, এখন আমি
কিংবা বন্ধু-বান্ধব সকলেই বিবাহিত এবং প্রত্যেকেরই ছেলে-মেয়ে আছে, সংসার আছে । তাই
এখন সম্পর্ক মানে পারিবারিক, ইচ্ছে করলেই যখন তখন দড়ী ছেঁড়া বলদের মত ছুটে পালানো
যায় না । এখন হাড়ে হাড়ে বুঝি – মানুষ দু’রকমের, জীবিত এবং বিবাহিত ।
হারিয়ে
যাওয়া স্কুলের বন্ধুদের কথা বলতে বলতে সংসারে ঢুকে পড়েছিলাম । যা হোক, সেদিন হাওড়া
থেকে ফিরছি । ভিড়ে ঠাসা মিনিবাসে একটা সিটে বসে আছি । হঠাৎ একজনকে কেমন যেন চেনা
চেনা মনে হ’ল । মনে হ’ল স্কুলের সেই চিন্ময় । চিন্ময়ের সঙ্গে লোকটার মুখের অদ্ভুত
মিল । চিন্ময়ের সঙ্গে কোনদিন দেখা না হলেও মাঝে মাঝেই আমি চিন্ময়ের সেই ঘটনাটা
স্ত্রী আর ছেলেকে শোনাই আর ওরা হেসে গড়িয়ে পরে । ক্লাস ইলেভেনে পড়ি তখন । আমাদের
বাংলা শিক্ষক লক্ষ্মী বাবুর অবসর গ্রহণের দিন আসন্ন । বাংলার ম্যাডাম নমিতা
ফাদিকার সকলকে লক্ষ্মী বাবুর জন্য বিদায় সম্বর্ধনা লিখে আনতে বললেন । যার লেখা
সবচেয়ে ভাল হবে সেটাই বিদায় অনুষ্ঠানে পাঠ করা হবে । ম্যাডাম ভীষণ কড়া – অতএব
সকলকেই লিখে আনতে হবে । বাড়ি ফিরে চলতে লাগল ‘বিদায় সম্বর্ধনা’র অনুসন্ধান – কঠিন
কঠিন দাঁত ভাঙা শব্দ ব্যবহারের প্রচেষ্টা । চিন্ময়ও এ বই সে বই ঘেঁটে লেখার চেষ্টা
করেছে । বাংলা বিষয়ে চিন্ময়ের ভীষণ ভীতি । ওর বাংলা ভাষা-জ্ঞান নিয়ে ম্যাডামের
ক্লাসে ওকে প্রায়ই ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ শুনতে হয় । তাই ইচ্ছে না থাকলেও চিন্ময়কে বিদায় সম্বর্ধনা
লিখতে হ’ল এবং জমাও দিল ঠিক সময়ে । তবে জমা দেওয়ার পরে ও বেশ গর্বের সঙ্গেই বলেছিল,
দারুন লিখেছি, দাদু স্কুলের হেড মাস্টার ছিল । দাদুকে বলার সঙ্গে সঙ্গে দাদু এমন
সুন্দর লিখে দিল না ! দেখে নিস ম্যাডামও অত সুন্দর লিখতে পারবেন না । ম্যাডাম
খাতাগুলো সংগ্রহ করে বাড়ি নিয়ে গেলেন । বলে গেলেন পরদিন সবার লেখা ক্লাসে পড়ে
শোনাবেন এবং তখনই ঠিক হবে কার লেখা বিদায় অনুষ্ঠানের দিনে মঞ্চে পড়া হবে । যথারীতি
পরদিন বাংলা ক্লাসের অপেক্ষায় উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করছি । ম্যাডাম ক্লাসে এসে একে
একে সবার লেখা পড়ে শোনাতে লাগলেন । ক্লাসের ফার্স্ট বয়ের লেখা পড়ার পর ম্যাডাম
সন্তুষ্ট হতে পারলেন না । তখনও অনেকের লেখা পড়া বাকি । ফার্স্ট বয়ের লেখা পছন্দ না
হওয়ায় সবাই এবার চিন্ময়ের লেখা শোনার অপেক্ষায় রইল । কারন সবাই জানে চিন্ময়ের
প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক দাদু ওটা লিখে দিয়েছে । কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হ’ল চিন্ময় সেদিন
ক্লাসে অনুপস্থিত । অবশেষে চিন্ময়ের খাতা । ম্যাডামের মুখে হাসি । সবাই ধরেই নিল
চিন্ময় ফাটাফাটি লিখেছে । ম্যাডামের হাসির আসল কারন এবার স্পষ্ট হ’ল । চিন্ময়
লিখেছে, লক্ষ্মী বাবু আজীবন অকৃতদার ছিলেন । ক্লাসে হাসির ফোয়ারা । লক্ষ্মী বাবুর
ছ ছ’টি ছেলে, তাদের মধ্যে একজন আবার এই স্কুলেরই করণিক । অকৃতদার শব্দটি চিন্ময়ের
খুব পছন্দ হয়েছিল, তাই দাদুর কাছে শব্দটির অর্থ যাচাই না করেই নির্দ্বিধায় লিখে ফেলেছিল
শব্দটা । অবশ্য পরিণাম তাকে ভোগ করতে হয়নি ক্লাসে অনুপস্থিত থাকার কারনে । পরে
জেনেছিলাম লেখা জমা দেওয়ার পরে চিন্ময় অকৃতদার শব্দটির অর্থ উদ্ধার করেছিল এবং
পরদিন ক্লাসে হাজির না থাকার কারন মূলত সেটিই ।
একসময় ঠিক
করলাম একবার ভদ্রলোককে ডেকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করব । সেই মত আসন ছেড়ে আস্তে আস্তে
এগিয়ে এলাম ভদ্রলোকের কাছে । দেখলাম ভদ্রলোক শিয়ালদার টিকিট কাটলেন । মত পালটে ঠিক
করলাম, আমার গন্তব্যও যখন শিয়ালদা, তখন শিয়ালদা নেমেই না হয় জিজ্ঞাসা করবো পরিচয় ।
শিয়ালদা নেমে ভদ্রলোকের কাছে যেতেই, একবার আমার মুখের দিকে তাকালেন ভদ্রলোক ।
তারপর আচমকা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “কিরে তুই অশোক না ?” ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমে
থতমত খেয়ে গেলেও পরক্ষণেই সামলে নিয়ে চিন্ময়কে নিয়ে চললাম চা খেতে । চিন্ময়ের এক
মুখ দাড়ি । অনেক কথা হ’ল । প্রায় তিন দশকের ব্যবধানে দেখা । সুতরাং জিজ্ঞাস্য
অজস্র । কিন্তু সময় কম । কোথায় থাকিস, কি করিস ইত্যাদি ইত্যাদি দিয়ে শেষ করে,
ঠিকানা, মোবাইল নম্বর বিনিময় করে বিদায় নেবার আগে বললাম বৌ-ছেলেমেয়েকে নিয়ে কবে
আসছিস আমাদের বাড়ি ? আসার আগে একটা ফোন করিস । চিন্ময় বলল, “অবশ্যই যাব, তবে একা”।
“কেন, একা কেন? পরিবার নিয়ে আয়, দারুন আনন্দ হবে”, আমি বললাম ।
চিন্ময়
এবার গম্ভীর গলায় বলল, “মানে বুঝেই বলছি, আমি অকৃতদার” ।