রাজনীতিকদের
আচরণ ও তার সামাজিক প্রভাব
-
অমরনাথ
কর্মকার
জনগণের দেওয়া ক্ষমতাবলে রাজনীতিকেরাই মূলত একটি দেশের বা রাজ্যের নীতিনির্ধারক ও দেশ বা রাজ্য পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত। একজন দক্ষ নাবিকের মত সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে দেশ বা রাজ্য নামক জাহাজকে তার
কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের (উন্নয়নের) দিকে নিয়ে যান রাজনীতিকরা। রাজনীতি এক ধরণের সুচারু শিল্প যার সাহায্যে জনগণ ও অনুগামীদের কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। রাজনীতিকেরা সৎ ও বিচক্ষণ হলে সে দেশ বা রাজ্যের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়—এ ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। আর এর বিপরীত কিছু ঘটলে সেই দেশ বা রাজ্যকে প্রতিনিয়ত ধুঁকে ধুঁকে চলতে হয় । বিগত বেশ কয়েক দশক ধ’রে আমাদের দেশে সার্বিক ভাবে যে অসুস্থ রাজনীতির চর্চা চলে আসছে, তা বদলানোর প্রয়াসে সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মহল নানাভাবে দাবি তুলে আসছে। বাস্তবে রাজনীতির এই অসুস্থতা নিরসনের কোন বাস্তব পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি, বা নেওয়ার চেষ্টা করা হয়নি। রাজনীতির একটা নিজস্ব ভাষা-শৈলি আছে যা প্রথাগত প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহৃত ভাষার চেয়ে ভিন্ন কিন্তু তা কখনোই অশালীন হ’তে পারে না। বিগত বেশ কয়েক বছর রাজনীতিকদের ভাষার শালীনতা হারানো শুরু হইয়েছে – শুরু হয়েছে ব্যক্তিগত আক্রমণের প্রবণতা। অশালীন বা কুভাষা প্রয়োগের মাত্রা বাড়তে বাড়তে তা ক্রমশ অশ্রাব্য হ’তে শুরু করেছে যা ভারতীয় রাজনীতির গৌরবকে প্রতিনিয়ত ম্লান ক’রে চলেছে। বিশেষ ক’রে শাসক-বিরোধীর মধ্যে যে অশালীন ভাষার প্রয়োগ শুরু হয়েছে তা রীতিমত ভাষাসন্ত্রাস। বিশেষত টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেল ও ইন্টারনেট নির্ভর বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে অপ্রীতিকর রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমাদের সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করছে।
বর্তমানে শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের অধিকাংশ রাজনীতিতে জড়িত হওয়ার প্রসঙ্গ উঠলেই গা এড়িয়ে চলে। এর দায়ভার আমাদের প্রবীণ রাজনীতিকদের নিতে হবে। কারণ, তাঁদের অধিকাংশই এমন ভালো কোনো উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে পারেননি, যা দেখে তরুণ প্রজন্ম রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ হবে। কিন্তু এভাবে আর কত দিন?
সৎ ও যোগ্য তরুন সম্প্রদায় যদি রাজনীতির মূলধারায় যুক্ত হতে না পারেন, তবে এই রুগ্ণ পরিস্থিতি থেকে মুক্তির সম্ভাবনা ক্ষীন। এ ক্ষেত্রে দু-একজন রাজনীতিক, যাঁরা সুস্থ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তাঁরা রাজনীতির মঞ্চে সঠিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তরুণ প্রজন্মকে রাজনীতিতে উৎসাহী করতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারেন। পাশাপাশি বিভিন্ন গণমাধ্যমেরও যথেষ্ট শক্তিশালী ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। আমরা চাই স্কুলের বা পরীক্ষার খাতায় ‘জীবনের লক্ষ্য’ রচনা লিখতে গিয়ে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার পাশাপাশি দক্ষ রাজনীতিবিদ
হওয়ার আন্তরিক ইচ্ছের কথাও স্বতস্ফূর্তভাবে লিখতে পারে অনেক ভবিষ্যৎ প্র্রজন্ম।
রাজনৈতিক দলগুলি ভারতীয় গণতন্ত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সুতরাং তাঁদের গণতান্ত্রিক ভাবে কাজ করার সঙ্গে দেশ বা রাজ্যের গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য ও প্রাণবন্ততা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।
এটা অনস্বীকার্য যে, আজকের সমাজ রাজনীতি শাসিত। রাজনীতিকরা দেশকে যেমন চালাতে এবং গড়তে চান, দেশের সমাজ ব্যবস্থা তেমনি চলে এবং গড়ে ওঠে। একসময়ে সমাজ গঠনে রাজনীতি-নিরপেক্ষ আদর্শনিষ্ঠ ধর্মগুরু, সমাজপতি ও শিক্ষকদের ভূমিকা ছিল মুখ্য। সে দিন আজ অতীত, এখন মূলত রাজনীতিকদের হাতেই সমাজ গঠনের চাবিকাঠি। প্রসাশন তো বটেই, আজ শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম থেকে শুরু করে অর্থনীতি সবই রাজনীতিকরা নিয়ন্ত্রণ করেন। বর্তমানকালে প্রায় সব দেশের সমাজ গঠনে এবং মানুষের সামাজিক আচরণে রাজনীতিকদের আচরণের এবং ভাবাদর্শের ভালোমন্দের প্রভাব অপরিসীম। এক কথায় বলতে গেলে, আজকের দিনে দেশের সমাজ গঠনে রাজনীতিকরাই প্রধান নির্দেশক ও শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ন। এরই জেরে দেশে রাজনীতিকদের দায়িত্বও বেড়ে গেছে শতগুণ। কিন্তু সে দায়িত্ব তারা সততার সাথে পালন করতে পারছেন কি ? রাজনীতিকদের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচার আচরণ প্রতিদিন সংবাদ ও সামাজিক মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ফলাও ক’রে প্রচারিত হচ্ছে যা ছোট বড় নির্বিশেষে সবার কাছেই কৌতুহলের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে সেগুলো টিভি সিরিয়ালের চেয়েও বেশি আকর্ষণের বিষয় হয়ে উঠেছে।
সমাজের নিয়ন্ত্রক রাজনীতিকরা নিজেরাই যদি দায়িত্বশীল আচরণ করতে এবং কথাবার্তা বলতে অক্ষম হন, তাহলে দেশের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দায়িত্বশীল আচরণ ও কথাবার্তা আশা নিরর্থক। রাজনীতিকরা যদি সুশিক্ষায় শিক্ষিত না হন তবে দেশের মানুষ সুশিক্ষিত হবে, তা প্রত্যাশা করা বৃথা। রাজনীতিকরা যদি শান্তিপ্রিয় এবং পরমত
বা পর-ধর্মসহিষ্ণু না হন, তা হ’লে সমাজে হিংসা, ধর্মীয় সংঘাত লেগেই থাকবে। রাজনৈতিক দলগুলির আদর্শগত বিভিন্নতা থাকতেই পারে, কিন্তু শুধু ক্ষমতা দখলের লোভে দুর্নীতি, হিংসার আশ্রয় নিলে সমাজ তার দ্বারা প্রভাবিত হতে বাধ্য। দলীয় স্বার্থের সংঘাতে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস প্রকট হচ্ছে যা সমাজকে ক্রমশ অসুস্থ ও অস্থির ক’রে তুলছে। সবকিছুই যেহেতু রাজনীতিকেন্দ্রিক, তাই সুস্থ সমাজ গড়ার দায়ভার রাজনীতিকদের নিতেই হবে।