সাকি (এইচ এইচ মুনরো) রচিত ‘দি
ওপেন উইন্ডো’ অবলম্বনে গল্পঃ অ না ক ০৮/০৪/২০১৫
বছর পনেরর
মেয়েটি বলল,“মিঃ নাটেল, পিসিমা এক্ষুনি নিচে নামবেন, এই ফাঁকে আসুন আমরা একটু
গল্পসল্প করতে থাকি”।
ফ্রামটন
নাটেল একটু অপ্রস্তুত বোধ করল । সে এখানকার কাউকেই চেনে না । না চেনারই কথা,
এক্কেবারে গ্রাম্য পরিবেশ । যে ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে এমনকি তাকেও সে
চেনে না । একমাত্র বোনের লেখা সেই চিঠিটাই তার ভরসা । বোন বলেছিল, সে এখানকার যাকে
যাকে চেনে প্রত্যেককে সে চিঠি লিখে দিচ্ছে । বোন আরও বলেছিল, “প্রত্যেকের সঙ্গে
দেখা করবি আর মিশবি, না হ’লে তোর অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে”।
তা যাই
হোক, কিছুক্ষণ চুপ ক’রে থাকার পর মেয়েটি বলল, “এখানকার কাউকে চেনেন-টেনেন?”
“না, না” ফ্রামটন
বলল, “বছর চারেক আগে আমার বোন এখানে এসেছিল একবার । তখন ওর সঙ্গে যাদের যাদের দেখা
হয়েছিল তাদের প্রত্যেকের উদ্দেশ্যেই সে চিঠি লিখে দিয়েছে দেখা করার জন্যে । তাদের
মধ্যে তোমার পিসিমার নামে চিঠিও আছে । তাই আমি ...”
“তার মানে
আপনি পিসিমা সম্বন্ধে কিছুই জানেন না ?”, মেয়েটি প্রশ্ন করল ।
“একেবারে
জানিনা যে তা নয়, নাম ঠিকানাটা জানি”।
“সেই
দুঃখজনক ঘটনাটা মানে সেই বিয়োগান্তক ঘটনাটাতো ঘটেছিল তিন বছর আগে”, ঝাঁঝিয়ে উঠে
মেয়েটি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ।
“ট্রাজেডি!”,
বিস্মিত হ’ল ফ্রামটন । এমন একটা ভরপুর শান্তির পরিবেশে দুর্ঘটনা আবার কি ঘটতে পারে
!
একটা খোলা
জানালা, যেটা দিয়ে সোজা লনে চলে যাওয়া যায়, দেখিয়ে মেয়েটি বলল, “আপনি হয়ত জানলাটা
খোলা দেখে অবাক হচ্ছেন – অক্টোবরের বিকেলে জানলা খোলা থাকাটা একটু আশ্চর্যের বৈকি”।
“এ বছর
অবশ্য এই সময়টা একটু গরমই আছে”, ফ্রামটন জানাল । “কিন্ত এই জানলার সঙ্গে সেই
দুঃখজনক ঘটনার কি কোন সম্পর্ক-টম্পর্ক আছে নাকি ?”
একটু ধরা
গলায় মেয়েটি বলতে শুরু করল, “তিন বছর আগে এই জানলা দিয়েই আমার পিসেমশাই আর দুই
কাকা শিকার করতে বেরিয়েছিল । কিন্তু জলা
পেরোতে গিয়ে তারা সকলেই কাদায় ডুবে যায় । তাদের কাউকেই আর খুঁজে পাওয়া যায়নি” ।
মেয়েটি বলল, “সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানেন, পিসিমা আজও বিশ্বাস করেন যে তারা
নিশ্চয় ফিরে আসবে, যে কোন দিন ফিরে আসবে । এমনকি ওদের সঙ্গী যে বাদামী রঙের
স্পেনিয়াল কুকুরটি কাদায় ডুবে গিয়েছিল, সেটাও নির্ঘাত ফিরে আসবে একদিন । শুধু তাই নয়, পিসিমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই জানলা
দিয়েই তারা ফিরে আসবে । তাই অন্ধকার না হওয়া পর্যন্ত পিসিমা প্রতিদিন জানলাটা খুলে
রাখেন । পিসিমা এখনও আমাকে শোনান ওরা কিভাবে রওয়ানা দিয়েছিল, কিভাবে ঝোলানো ছিল
পিসেমশাইয়ের হাতের সাদা ওয়াটারপ্রুফটা, পিসিমার ছোট ভাই, মানে আমার কাকা, কিভাবে হেঁড়ে গলায়
গান গাইছিল সব । জানেন, আমি পিসিমার এই গল্পগুলো শুনি আর আতঙ্কে কেঁপে উঠি, সত্যিই
যদি কোনদিন দেখি ওরা জানলা দিয়ে ফিরে আসছে !” কথাগুলো বলতে বলতে মেয়েটি কেমন যেন
শিউরে উঠল । ফ্রামটন ঘাবরে গিয়ে মেয়েটিকে কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় ঘরে প্রবেশ
করলেন সেই ভদ্রমহিলা ।
“ভেরা
নিশ্চয়ই এতক্ষণ মজা করছিল?”, ভদ্রমহিলা বললেন ।
“ও চমৎকার
মেয়ে”, ফ্রামটন বলল ।
“ওরা
এক্ষুনি ফিরবে এবং এখান দিয়েই । তারপর কার্পেটটা কাদায় মাখামাখি করবে । বোঝেনই তো
ছেলেদের যা স্বভাব !” কথাগুলো বলার পরে আবার অনর্গল বর্ণনা শুরু করলেন শীতকালে
শিকারে গেলে কি ধরণের হাঁস পাওয়া যায় ইত্যাদি ইত্যাদি । ফ্রামটন প্রসঙ্গান্তরে
যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল, কিন্তু সে দেখল অন্য কোন দিকে ভদ্রমহিলার লক্ষ্য নেই,
তিনি ক্ষণে ক্ষণে খোলা জানলাটার দিকে তাকাচ্ছেন ।
“আসলে
ডাক্তারের নির্দেশমতো আমার সম্পূর্ণ বিশ্রামের প্রয়োজন আর সেই সঙ্গে যে কোন ধরণের মানসিক
উত্তেজনা থেকে দূরে থাকা দরকার” ভদ্রমহিলার কথার প্রবাহ একটু স্থিমিত হলে ফ্রামটন
ভদ্রমহিলাকে কথাগুলো শোনাতে পারল । ফ্রামটন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারল না একজন
সম্পূর্ণ অপরিচিত ভদ্রমহিলাকে সে কি করে বোঝাবে যে যাদের কোনদিনই ফিরে আসার
সম্ভাবনা নেই তাদের যাত্রার খুঁটিনাটি বিবরণ কতটা অপ্রাসঙ্গিক ।
ফ্রামটনের
কথাটা শুনতে পেয়ে মিসেস স্যাপলটন হাল্কাভাবে বললেন, “তাই নাকি?” হাঁই তোলা আটকাতে
যেমন আওয়াজ হয়, মিসেস স্যাপলটনের কথাটা অনেকটা সে রকমই শোনাল । তারপরই আকস্মিকভাবে
তাঁর চোখে মুখে ফুটে উঠল উজ্জ্বলতা । অবশ্য তা ফ্রামটনের বক্তব্যের কারনে নয় ।
মিসেস
স্যাপলটন চিৎকার করে উঠলেন, “যাক বাবা, শেষ পর্যন্ত তাহলে ওরা ফিরল, একেবারে ঠিক
সময়ে । যাই, ওদের জন্য চা ক’রে আনি”।
ঘটনার
আকস্মিকতায় ফ্রামটন মুহূর্তে আতঙ্কিত হলেও সহানুভূতির দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকাল
। আতঙ্কে ভরা দুচোখ মেলে মেয়েটি তাকিয়ে আছে সেই জানলাটার দিকেই । ফ্রামটনও এবার
দৃষ্টি ফেরাল সেই দিকেই ।
ফ্রামটন
দেখতে পেল বিকেলের পড়ন্ত আলোর আবছায়ায় তিনটি ছায়ামূর্তি যেন এদিকেই এগিয়ে আসছে ।
তাদের পায়ের কাছে চলমান ছোট্ট একটা স্পেনিয়াল । আবছায়ায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সবার হাতে বন্দুক,
তাদের মধ্যে একজনের কাঁধে একটা সাদা কোট । ওদের মধ্যে কে যেন হেঁড়ে গলায় আবার গানও
ধরল ।
এবার
ফ্রামটন তার ছড়িটা উঁচিয়ে ধরল । মুহূর্তে শোনা গেল বাইরে নুরি পাথর থেকে ভেসে আসা
তার পালিয়ে যাওয়ার শব্দ ।
“আমরা
ফিরে এসেছি”, জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকে জানিয়ে দিল সেই ভদ্রলোক যার কাঁধে শোভা পাচ্ছিল সেই
কোটটা । কিন্তু আবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, “আমরা ঢোকার আগেই কেউ একজন পালিয়ে গেল
বোধ হয় ! সে কে ?”
মিসেস
স্যাপলটন জবাব দিলেন, “মিঃ নাটেল নামের একজন । অদ্ভুত ধরণের মানুষ, কেবল নিজের
শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে কথা বলছিল । তোমরা আসছ দেখে ভূত দেখার মত পালিয়ে গেল, একবার
বলে যাবার মত সৌজন্য পর্যন্ত দেখাল না”।
“বোধ হয়
কুকুরটাকে দেখে ভয় পেয়েছে”, মেয়েটা মন্তব্য করল । “লোকটা বলেছিল কুকুরে তার ভীষণ
ভয় । একবার নাকি একপাল কুকুর ওকে তাড়া করে নদীর ধারের এক গোরস্থানে নিয়ে তুলেছিল
। সেখানে নতুন খোঁড়া এক কবরের ভিতরে ঢুকে
তাকে নাকি সারারাত কাটাতে হয়েছিল কারন কুকুরেরা তাকে চারদিক দিয়ে রাতভর ঘিরে রেখেছিল
। এমন ঘটনার সম্মুখীন হওয়া একজন মানুষের পক্ষে কুকুর দেখে ভয় পাওয়া অত্যন্ত
স্বাভাবিক”।
চটজলদি
গল্প ফাঁদা মেয়েটির একটা মস্ত গুণ ।