রাজনীতির
অশালীন ভাষাঃ অমরনাথ কর্মকার
রাজনীতি মূলত শাসন করার এক ধরণের সুচারু শিল্প যার সাহায্যে
জনগণ ও অনুগামীদের কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায়
রাজনীতিকদের অন্যতম মূল অস্ত্র রাজনৈতিক ভাষা প্রয়োগ। পৃথিবীর সমস্ত দেশেই ক্ষমতা পাওয়ার
সুযোগ যখন সৃষ্টি হয় অর্থাৎ নির্বাচনের আগে রাজনীতিকদের কৌশলী ভাষার ব্যবহারের তৎপরতা
শুরু হয়ে যায়। উদ্দেশ্য, নির্বাচকদের তাদের দলের পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য প্রভাবিত করা।
এক্ষেত্রে রাজনীতির একটা নিজস্ব ভাষা-শৈলি আছে
যা প্রথাগত প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহৃত ভাষার চেয়ে ভিন্ন। অনেক সময় আমাদের ভাষার
ব্যবহারে তা যুক্ত হয়ে যায়, আবার অনেক ক্ষেত্রে কোন শব্দের বা শব্দগুচ্ছের আভিধানিক
অর্থের বিকৃতি ঘটায়। আমরা পশ্চিমবঙ্গে থাকি ব’লে
বাংলা ভাষা নিয়েই আমাদের চর্চা।
ইতিপূর্বে রাজনীতিতে আমরা তার নিজস্ব শৈলির ভাষা ব্যবহৃত
হ’তে দেখেছি। ব্যতিক্রম বাদ দিলে সাধারণভাবে কখনোই তা অশালীনতা ও ব্যক্তিগত আক্রমণের
দোষে দুষ্ট ছিলনা। তারপর রাজনীতিকদের ভাষার
শালীনতা হারানো শুরু হ’ল – শুরু হ’ল ব্যক্তিগত আক্রমণের প্রবণতা। অশালীন বা কুভাষা
প্রয়োগের মাত্রা বাড়তে বাড়তে তা ক্রমশ অশ্রাব্য হ’তে শুরু করেছে যা বাংলা ভাষার গৌরবকে
প্রতিনিয়ত ম্লান ক’রে চলেছে। সম্প্রতি টিভির পর্দায় বা রাজনৈতিক মঞ্চে রাজনীতিকদের
মুখে লাগামহীন অশালীন ভাষা প্রয়োগের যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে তা বাংলা ভাষার মর্যাদাকে
ভুলুন্ঠিত ক’রে চলেছে। নিজেদের পক্ষে জনসমর্থন পাওয়ার মহান উদ্দেশ্য সাধনে যে ধরণের
নীচতা প্রদর্শিত হচ্ছে তা নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়।
স্লোগান বা ভাষা হওয়া উচিৎ নীপিড়িত মানুষের ভাষা – যা মানুষের
মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করে। রাজনীতির ভাষা চাতুর্যপূর্ণ হোউক ক্ষতি নেই, কিন্তু তা যেন
হয় জনগণের দিকনির্দেশনামূলক। রাজনীতির ভাষা এমন হওয়া উচিৎ সাধারণ মানুষ যেন সে ভাষা
বুঝতে পারে, পক্ষান্তরে রাজনৈতিক দলগুলোও যেন জনগণের ভাষা পড়তে পারে। এতে সাধারণ মানুষের
সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা বাড়ে। যত দিন যাচ্ছে, রাজনীতিকদের গঠনমূলক কোন সমালোচনা
বা চমক সৃষ্টিকারী কোন কর্মসূচি গ্রহণ করতে দেখা যায় না – শোনা যাচ্ছে শুধুই লাগামহীন
দোষারোপের রাজনীতি, পারস্পরিক কাদা ছোঁড়াছুড়ি। বর্তমানে যে ধারা আমরা প্রত্যক্ষ করছি তাতে রাজনীতিকদের ভাষায় জনগণের মনের ভাষার প্রতিফলন
আদৌ নেই। কারন, তাতে না আছে গঠনমূলক সমালোচনা, না আছে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য। বরং
তা অশালীনতার মাত্রা ছাড়াচ্ছে। সম্প্রতি পশ্চিমবাংলায় রাজনীতিকদের অশালীন, কুরুচিকর
ভাষা প্রয়োগের যে বন্যা বইছে তাতে মানুষের মনে আশার সঞ্চার তো দূরের কথা, মানুষ আসন্ন
ভয়াবহ দিনের কথা ভেবে রীতিমত শঙ্কিত। সবচেয়ে বড় কথা, অশালীন কুরুচিকর ভাষা ব্যবহারকারী
রাজনীতিকদের মুখে লাগাম পরানোর কোন তৎপরতা দলের নিয়ন্ত্রক নেতা-নেত্রিদের মধ্যেও দেখা যায় না। রাজনীতির আভিধানিক
অর্থ নীতির রাজা। তাহ’লে রাজনীতি হওয়া উচিৎ শুদ্ধ এবং তাঁর ভাষা হওয়া উচিৎ পরিশীলিত।
বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক সাধারণ মানুষ রাজনীতির প্রতি আস্থাহীনতায়
ভুগছেন – রাজনৈতিক দলগুলির সাথে জনগণের একটা অবিশ্বাস ও অনাস্থার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
এই বাস্তব পরিস্থিতি কিন্তু উন্নয়নের অন্তরায়। যে জনগোষ্ঠী ভোটে রাজনৈতিক দলগুলি ক্ষমতা
ভোগের আশায় বুক বাঁধছে, সেই জনগণের মনের ভাষা যদি রাজনৈতিক দলের নেতাদের মুখে উচ্চারিত
না হয় তাহ’লে সাধারণ মানুষের মনে উদ্ভুত অনাস্থা ধীরে ধীরে রাজনীতিকে জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন
ক’রে দেবে। তখন রাজনীতি হয়ে উঠবে গোষ্ঠীকেন্দ্রিক। রাজনীতির এই পরিণাম কখনোই কাঙ্খিত
নয়।
সুতরাং রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনের
জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন রাজনীতির ভাষা সংস্কার। রাজনীতিকদের ভাষার ব্যবহারে লাগাম টানতে,
অশালীন ভাষার প্রয়োগ রোধ করতে নতুন ধারা প্রবর্তনের আশু প্রয়োজন। রাজনীতির ভাষা হ’ল
স্বপ্ন দেখা আর মানুষকে স্বপ্ন দেখানোর ভাষা। এতে মিশে থাকে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ মেশানো
পরিশীলিত শব্দ চয়ন। রাজনীতি তো দেশের উন্নয়নের সবচেয়ে মূল্যবান অস্ত্র।