মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ


সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ
অমরনাথ কর্মকার
প্রযুক্তির সাথে প্রযুক্তির দ্বন্দ্ব এবং তার পরিণাম যে কি হবে তা নিয়েও তৈরি হয়েছে ধন্দ। ব্যাপারটা সংবাদপত্র সহ অন্যান্য মুদ্রণ মাধ্যমের সঙ্গে আধুনিক বিভিন্ন বৈদ্যুতিন মাধ্যমের মধ্যে অস্তিত্বের সংগ্রাম।  প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নতির ধাপ অতিক্রম ক’রে সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম আধুনিক অবয়বে হাজির হয়েছে পৃথিবীকে আমাদের ড্রয়িংরুমে এনে হাজির করানোর গুরুদায়িত্ব নিয়ে। কিন্তু সমান্তরালে ভিন্ন প্রযুক্তির অভাবনীয় আবিষ্কারে ধাপে ধাপে আত্মপ্রকাশ করেছে বেতার, টেলিভিশন থেকে আজকের ইন্টারনেট সহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম। এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আজ সংবাদপত্রকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, একুশ শতকের প্রযুক্তিগত বিপ্লবে আদৌ কি অস্তিত্ব রক্ষা করতে সক্ষম হবে আমাদের একদা সকালের প্রাত্যহিক সঙ্গী সংবাদপত্র  ?

অস্তিত্বের সঙ্কটের আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে প্রশ্নটা উঠছে অন্য ভাবে – আজকের মুদ্রিত সংবাদপত্র কি অচিরেই তার ঐতিহ্য হারিয়ে মাধ্যম পরিবর্তন ক’রে শুধুই ইন্টারনেটে দৃশ্যমান থাকবে  ? নাকি সংবাদপত্র হারিয়ে ফেলবে তার নিজস্ব স্বাদ, কাঠামো, ধারা ও বৈশিষ্ট্য  ?

প্রশ্নগুলো স্বাভাবিক কিন্তু উত্তর বড্ড কঠিন। সঙ্গত কারনেই প্রশ্নগুলো সংবাদপত্রের পাঠকের মনে উঁকি দিতে শুরু করেছে। পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রের মুদ্রিত সংখ্যা বন্ধ হয়ে ঠাই হয়েছে অনলাইনে। এসব দেখেই সংবাদপত্রের অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় দানা বাঁধছে জনমানসে। তবে ইন্টারনেটের মত আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে অস্তিত্বের সংগ্রামে সংবাদপত্র কিন্তু এখনও হেরে যায়নি।
আঞ্চলিক ভাষায় সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিকের শিরোপা এই বাংলারই একটি সংবাদপত্রের। তথাপি অডিট ব্যুরো অফ সার্কুলেশনের সাম্প্রতিক সমীক্ষানুসারে ভাষাভিত্তিক সংবাদপত্র পাঠের ভিত্তিতে ভারতের অনেক আঞ্চলিক ভাষার তুলনায় বাংলা ভাষার সংবাদপত্র পাঠকের সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান ।  অডিট ব্যুরো অফ সার্কুলেশনের আর একটি সমীক্ষা বলছে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে মুদ্রণ মাধ্যমের সংখ্যাধিখ্য ঘটেছে যা সংবাদপত্রপ্রেমী মানুষদের কাছে আশাব্যঞ্জক।  আমাদের দেশে বৈদ্যুতিন মাধ্যমের বাড়বাড়ন্তের ফলে সংবাদপত্রের অস্তিত্বের সংকট নিয়ে যে সংশয় তৈরি হয়েছে সংবাদপত্রের ওপর তার বাস্তব প্রভাব যে সেভাবে পড়েনি তা সংবাদপত্র প্রেমীদের যে আশ্বস্ত করবে, তা বলাই বাহুল্য। তবে একথা ঠিক যে আধুনিক সংবাদপত্রে সাংবাদিকতার রীতি ও রেওয়াজের যথেষ্টই পরিবর্তন হয়েছে।  
মুদ্রিত সংবাদপত্র এখন তাৎক্ষণিক সংবাদ পরিবেশনে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। কারন টেলিভিশন ও ইন্টারনেটের মত দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যমগুলো তাৎক্ষনিক সংবাদ পরিবেশনে অনেক অগ্রণী। এই মাধ্যমগুলিতে ঠিক এই মুহূর্তে যে সংবাদটি পরিবেশিত হচ্ছে, সেই খবরটিই সংবাদপত্রে ছাপার অক্ষরে আমাদের হাতে আসবে আগামীকাল। ততক্ষণে সেই সংবাদের প্রতি আগ্রহ ও উৎসাহ অনেকটাই স্থিমিত হয়ে যাবে। বিশেষত আধুনিক মোবাইল ফোনের দৌলতে হাতের তালুতেই পেয়ে যাচ্ছি হাতে গরম খবর । তা ছাড়া অধিকাংশ সংবাদপত্রই এখন হাজির ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। সুতরাং বাসী খবর পড়ার জন্য আগামীকালের সংবাদপত্রের অপেক্ষায় থাকা আগ্রহী মানুষের সংখ্যা অর্থাৎ মুদ্রিত সংবাদপত্রের পাঠকের সংখ্যা ক্রমশ নামছে । এক্ষেত্রে সংবাদপত্রগুলি নিজেরাই আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মুদ্রিত সংখ্যা প্রকাশের পাশাপাশি ইন্টারনেট সংখ্যাও চালু ক’রে অর্থের বিনিময়ে ইন্টারনেটে গ্রাহক বৃদ্ধির ব্যবসায় মশগুল। অনেক ক্ষেত্রে ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, গুগল প্রভৃতি ইন্টারনেটনির্ভর সামাজিক মাধ্যম সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে গতির নিরিখে টেলিভিশনকেও হার মানাচ্ছে।
মোবাইল ফোন আসার পরেও অনেক বছর পর্যন্ত ঐতিহ্যবাহী ল্যান্ডলাইনের যথেষ্ট কদর ছিল। তার প্রথম কারন, মোবাইল ফোনের প্রযুক্তিগত কলাকৌশল সম্বন্ধে ধারণার অভাব। বিশেষত আমাদের মত শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারে অক্ষমতার কারনে এই ফোন ব্যবহারেও অনীহা ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে মোবাইল ফোন ব্যবহারের মানুষের মধ্যে সম্যক ধারণা তৈরি হবার পর এবং সর্বোপরি মোবাইল ফোনের প্রযুক্তিগত সুবিধার কথা মাথায় রেখে ল্যান্ড লাইনের ব্যবহার প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। সংবাদপত্রের দশাও যে ল্যান্ড লাইন ফোনের মত হবে না সে কথা কে বলতে পারে  ? আমাদের দেশে শিক্ষিতের হার কম এবং দারিদ্র্যের হার বেশি হওয়ায় এখনও পর্যন্ত সংবাদপত্রের পাঠকের সংখ্যা হ্রাসের হার ততটা উদ্বেগের কারন হয়ে দাঁড়ায়নি। তবে আমরা কিন্তু সেই পথেই এগোচ্ছি।  এই ভাবেই বৈদ্যুতিন মাধমের সৌজন্যে সিনেমা হলের সংখ্যা কমছে – বাড়ছে ইউটিউবের মত মাধ্যমের জনপ্রিয়তা।
এভাবে চলতে থাকলে এমন দিন আসতে বোধ হয় খুব একটা দেরি নেই যখন মুদ্রিত সংবাদপত্রের স্থান হবে মিউজিয়ামে – ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে। তবে সবটাই নির্ভর করছে প্রযুক্তির সঙ্গে প্রযুক্ত্রির দ্বন্দ্বে কে জেতে কে হারে তার ওপর । সবকিছুতেই ‘পেপারলেস’ করার যে উদ্যোগ বিশ্বব্যাপী পরিলক্ষিত হচ্ছে তাতে মুদ্রণ মাধ্যমের ভবিষ্যত বোধ হয় মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়।   



মুখ চাপা সত্য

 মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু  নাকি সত্যের চির সমাধি?  নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?